(উপন্যাস/Novella)
তাপস সরকার
পর্ব ১
কিছুক্ষণ হল সূর্য ডুবেছে। শীতের সন্ধ্যার ঠান্ডা বাতাস কান ঘেঁষে যাচ্ছে বুঝতে পারছি। মাঠের সবুজ ঘাসগুলি ধীরে ধীরে কালো রঙের চাদরে জড়িয়ে যাচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে। কেবল আমরা দুজন কালো পাহাড়ের মত ওদের মাঝে জেগে বিড়বিড় করে বকে যাচ্ছি। আমি একটা হাই তুলে দীর্ঘ্য শ্বাস ফেললাম।
শঙ্কর পকেট হাতড়ে কুচকানো প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে বলল, "খাবি!
আচ্ছা তুই তো আবার খাস না।"
"আর একটাই আছে, আমিই লুফি।"
আমি বললাম, "আরে ভাই কোনো ব্যাপার না, খেয়ে নে, খেয়ে নে।"
শঙ্কর দেশলাই বের করে দু তিন বার ছ্যাঁক ছ্যাঁক করে বিড়িটায় আগুন জ্বালল। হালকা অন্ধকারে জ্বেলে ওঠা বিড়ির আগুনের ফুলকিতে দেখলাম ও চোখ বন্ধ করে একটা সুখটান দিচ্ছে।
আমি আঁড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, "ওহ্, সেই মজা নাহ্! বিড়ি শিল্পে বড্ড পারদর্শী হয়ে উঠেছিস দেখছি।"
ও কোনো কথা বলল না।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওর কোনো উত্তর পেলামনা। আমার ভেতরটায় মনে হল মস্করা করতে গিয়ে ভুল করে ফেললাম নাকি। আসলে আচমকা এরকম একটা স্তব্ধতার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলামনা। তাই লাল সূর্যের ক্রমাগত কনকনে অন্ধকারে আমি নিজে নিজেই অপমানিত বোধ করলাম। ওর সঙ্গে প্রায় অনেক দিন পর দেখা, ফোনেও ঠিকঠাক কথা হয়নি। ও একটু অন্য রকম, কথা কম বলার দর্শনে বিশ্বাসী। জানিনা এই ক-বছরে ওর ভেতরে আমাদের সাহিত্যরস ও জীবন সমকক্ষতার স্বাদের পরিবর্তন হয়ে গেছে কিনা। আমি দুর্বল হৃদয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলাম।
দ্বিতীয় সুখটান দিয়ে শঙ্কর বলল, "আরে মজা মানে! বলিস কি এডা ছাড়া কি আর এত দিন বাঁচতে পারতাম?"
"তুই তো কবিতা, রিসার্চ, চাকরি নিয়ে একটা রুটিন মাফিক জীবনে চলিস, তোর সুখ আলাদা হবে।
তবে ভাই এই একটা বিড়িই আমার জীবন। যা কিছু করি, যা কিছু করায় এই বিড়ি।"
আমি ওকে আটকাতেই বললাম, "চল আর উচ্চ মানের গালি দিসনা। শিক্ষা, চাকরি, টাকাই সব কিছু না, জীবনের লক্ষ্য আমাদের সবার আছে অন্য ভাবে।"
বিড়ি ঝেড়ে শঙ্কর বলল, "শুনলাম তোর জ্ঞান, আচ্ছা চল এখন একটু সাহিত্য চর্চায় আশা যাক, যে বিষয়ে আজ আমাদের আলোচনা করার কথা।"
"আচ্ছা চল" আমি বললাম।
"সাহিলের ফেসবুকে কদিন আগে একটা কবিতা পড়েছিলাম, তুই পড়েছিস? শঙ্কর বলল।
"না রে।"
"তাই। তোরা ব্যস্ত মানুষ, প্রফেসর, তোদের কি আর সময় হয়!"
"আরে ভাই। কয়েক মাস একটু ব্যাস্ত ছিলাম রিসার্চের কাজে। তাই ফেসবুক টা ঘাটা হয়নি তেমন। যাইহোক দেখব।
"হুম। কবিতাটিতে রাজনীতি ও ধর্ম কে নিয়ে লিখেছে ও। ভালো লিখেছে, কিন্তু শেষে একটা লাইনে লালদের নিয়ে অতিরিক্ত বলেছে। সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে অতিরঞ্জন। যাইহোক সেটা ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার।"
"এটা ঠিক নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়েই তো আমাদের সব লেখা।"
"তা ঠিক। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা স্বাভাবিক জিনিসগুলোকে এত অস্বাভাবিক করি অনেক সময় সেগুলি কেমন যেন অকৃত্রিম, অযৌক্তিক দেখায়।"
"ঠিক বলেছিস, ঠিক বলেছিস। লেখা লিখলেই সবকিছু হয় না। লেখার মধ্যে যদি সত্যের সঠিক স্বাদটা নাই থাকল, সে লেখায় লাভ নেই। সে যত বড় লেখক বা বই প্রকাশক হোক।"
"হ্যাঁ, আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করবি একজন নামি লেখকের সব লেখা কিন্তু ভালো স্বাদ দিতে পারেনা। পুরোটাই নির্ভর করে লেখকের অভিজ্ঞতা, পরিবেশন, শব্দযোগ, অবশেষে একটা ভালো প্রকাশন। তাছাড়া এখন তো ফেসবুক, ইনস্টাতেই ভালো ভালো কবিতা কাহিনী পড়ি।"
"হুম, তোর সঙ্গে এক্কেবারে সহমত। চল তুই একটা কবিতা শোনা আজ। অনেক দিন হল তোর মুখে কবিতা শুনিনি, ওই গুগল মিট-এ শুনিয়েছিলিস একবার।"
শঙ্কর বিড়িতে শেষ টান দিয়ে বলল, "আহ্; আমার কবিতা! শুনবি তুই?"
"হ্যাঁ রে ভাই শোনা। এই জন্যই তো আজকের এই বিশেষ সাক্ষাৎ। দাড়া, আমাকে একটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক চালাতে দে।"
"হুম... চালা। ততক্ষণে আমি খুঁজছি কোনটা শোনাব তোকে।"
ফোনের ভলিউম বাড়িয়ে আমি বেনসাউন্ড ডট কম থেকে 'গ্রীন-প্ল্যানেট' মিউজিক চালিয়ে দিলাম। ততক্ষণে শঙ্কর ওর কবিতা বের করেছে। আমি দেখলাম অন্ধকার থেকে ও ঝুঁকে পড়েছে ওর ফোনের উজ্জ্বল ডিসপ্লের ওপর। আমার ফোনে 'গ্রীন-প্ল্যানেট' বেজে চলেছে আপলিফ্ট মুডে। আমি স্থির চোখে ওর ঝুঁকে পড়া মগ্নতায় চেয়ে আছি। আমার চোখের সামনে আমি অনুভব করছি এক সত্যিকারের জ্বলন্ত কবি সত্তাকে। শঙ্কর স্পষ্ট শব্দ ও ছন্দে ওর কবিতা পড়ে চলেছে:
ওদের চোখে অন্ধকার
আমার বিশাল চিৎকার,
ওরা সবাই আলো খুঁজে
উল্কা, তারা, নক্ষত্রে;
ওরা গল্প খেয়ে গাঁজা দেখে
ভিখারীর ক্ষুধায়,
ওরা ন্যাংটা হয়ে সমাজ গড়ে
পোশাক কেনা বেচায়;
ওরা শিক্ষা বেচে মানুষ কিনে
মানুষ কিনে শিক্ষা বেচে,
ওরা নিকৃষ্ট সভ্যতার বুকে
উৎকৃষ্ট মুখোশ মানুষ সেজে;
ওদের ধর্ষণে আজ আমি বিষাক্ত
নপুংসক ভ্রূণের ভবিষ্যতে,
আমি মৃত্যুকে আজ আপোষ করি
আমার সবুজ রক্ত সংশোধনে;
আজ আমার শরীর হৃদয় থেকে আলাদা
হৃদয় জ্ঞানের নেশায় ঘোরতর,
আমি চিৎকার করি রক্ত চাই রক্ত চাই,
সবুজ রক্তে আমায় রঙিন কর;
আমার চিৎকারে পাহাড় ভেঙে পড়ে
গলে সূর্যের তাপে বরফ পাহাড়,
শুধু তোমরা আজও বদ্ধ ঘরে ঘরে
জ্ঞান, হৃৎপিণ্ড, রক্ত বেচেঁ অন্ধকার;
একি! আজ দীর্ঘ্য সময় পর
তোমরা আমায় কঙ্কাল দেখো?
হ্যাঁ, আমি মৃত কয়েক দশক আগে
তোমরা মৃত ভ্রূণ হয়ে আমায় স্মরণ করো...