The Poet's Pen 20s Logo

Friday, November 19, 2021

অন্ধকার, এক পৃথিবী

 (ছোটগল্প)
তাপস সরকার

দৈনন্দিন রুটিনের অধিকাংশ কাজগুলি সেরে, হাতে একটি ইংরেজী ট্রান্সলেটেড অ্যান্থলজি নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছিলাম, ভেবেছিলাম ভালো একটা কবিতা দেখলেই টুক করে পড়ে নেব। কিন্তু মন মতো খুঁজে পাচ্ছিলামনা। হয়তো হেডিং দেখে পড়ার আমার যে একটা বাতিক আছে, তাই মনের হুকুমে অস্বাভাবিক অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এভাবে চলতে চলতে বইটির মোটামুটি মাঝখানে গিয়ে আঙ্গুল থামল। দেখলাম, কবিতার হেডলাইন লেখা আছে "Love", লিখেছেন রুমি, ত্রয়োদশ শতকের একজন বিখ্যাত পার্শিয়ান ইসলামিক স্কলার ও কবি। যদিও দীর্ঘ্য সময় ধরে এই "Love" শব্দকে কেন্দ্র করে আমার লিখালিখি প্রায় বিরত আছে, কিন্তু আজকে লেখার সাথে সাথে পড়ার অনুভূতিটাও কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিল। অগত্যা, জলদি মনস্থির করে ফেললাম, বইটি দুভাগে ভাগ করে ডানদিকের অংশে ফোনটি রেখে পড়তে শুরু করলাম। 


    প্রথম চার লাইন শেষ করে কবিতার দ্বিতীয় চার লাইন শেষ করতে না করতেই শুনলাম দরজায় কেউ খট্ খট্ করে আওয়াজ করছে। কিছুক্ষন অপেক্ষা করে থাকলাম। আবার বাজল। দরজা খুলতেই দেখি পাশের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ভদ্রমহিলা এসেছেন উনার তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে, হাতে একটি প্লেট। আমি একটু ইতস্তত হয়েই তাকিয়ে রইলাম, বললাম "আচ্ছা আপ"! তারপর উনি প্লেটটি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন "কুচ ব্রেড অর ফ্রাই রাইস হ্যা, রাখ দিজিয়ে", "your roommates didn't come yet?" আমি বললাম, "নেহি, maybe on 17th they will come. আমি প্লেটটি নিয়ে রান্না ঘরে রাখতে যাচ্ছি, উনি বললেন তখনই প্লেটটি ফেরত দিতে। তাই খাবার গুলি আমার প্লেটে রেখে ফেরত আসলাম দরজার দিকে। দেখলাম উনি দাড়িয়ে আছেন। প্লেটটি ফেরত দিলাম। ছোটো বাচ্চাটিকে দু একবার হাই হ্যালো বললাম, কিন্তু সে লজ্জা পাচ্ছিল। কোনো কিছু না বলে মায়ের ওড়না ধরে লুকোতে চাচ্ছিল। তখনই ভদ্রমহিলা বললেন " আব তোহ আপ ইহা রহেঙ্গে নাহ, থোড়া ইসকো পড়ায়েঙ্গে?" আমি বললাম " ভাবিজি আব তোহ ইতনা টাইম নহি হামারা পাস, actually we are having exam on 25th of this month." কোই বাত নহি থোড়া আধা ঘণ্টা ব্যাস, লাস্ট টাইম হাম লোগ যাদা দিন নহি রহা ইসবার রহেঙে...।"


    এমনিতেই না বলার সঠিক পদ্ধতিটা আমার জানা খুব কম। আমি বেশ কিছুবার না বলা সত্ত্বেও উনি বার বার জোর করতে লাগলেন। শেষমেষ, আমি বললাম, " ঠিক হ্যা ভেজ দিজিয়ে কাল, ৬ পিএম।" "ওকে", বলে পরে পরেই উনি বিদায় নিলেন। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিলের সামনে এসে বসলাম। বাইরে একটু অন্ধকার নেমেছে। মন স্থির করতে পারছিলামনা দ্বিতীয়বার পড়া শুরু করার। এদিকে জানলা দিয়ে খুব কম আলো বইয়ে প্রতিফলিত হচ্ছিল তাই দেখতেও অসুবিধে হচ্ছিল পড়ার অংশটি। হঠাৎ দেখলাম ফোনের সময়, সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা পার হয়ে গেছে। দ্বিতীয়বার আর অর্ধেক পড়ে রাখা কবিতাটি পড়ার ইচ্ছে হলনা। ভাবলাম এখুনি অন্ধকার হয়ে যাবে, যাই একটু ছাঁদ থেকে ঘুরে আসি। বদ্ধ ঘরের প্রেমের কবিতার পৃথিবীর চাইতে খোলা আকাশের নিচে পায়চারী অনেক স্বাস্থ্যকর ও সুখ। 


    রুমির প্রেমের কবিতা আর পড়া হলনা। গায়ে একটা ফুল শার্ট জড়িয়ে, হেডফোনটি কানে গুঁজে সিড়ি বেয়ে ছাঁদের দিকে উঠতে লাগলাম। উঠতে উঠতে রুমির কবিতার শেষ অংশটি মনে করতে চেষ্টা করলাম যেটি কিছুক্ষণ আগেই পড়েছিলাম। কিন্তু কিছুতেই, স্থির হয়ে শেষের লাইনটি মনে করতে পারছিলামনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হতে লাগল। আমি উপরে উঠতে লাগলাম। ছাঁদের সিড়ির দরজা খুলে দেখলাম লালচে আকাশ, তাতে নীল কালো রঙের কিছু ছাপ। দুর্বল ধূসর মেঘগুলো এলোমেলোভাবে এদিক ওদিক ছড়িয়ে। পূর্ব দিকের আকাশ কিছুটা ঘন অন্ধকার। ছাঁদের ডানদিকে দেখলাম কেউ আগুন জ্বালিয়েছে, সেই আগুনের ঝোঁপ থেকে একগুচ্ছ ধোঁয়া আঁকাবাঁকা লেনের মতো উপরে উঠে যাচ্ছে। বাঁদিকের একটি বাড়িতে কিছু ছেলে মেয়ে দীপাবলি আর ছোট পূজার লাইটিং তারগুলি খুলছে। ওদের কথোপকথনের দু একটা অস্পষ্ট হিন্দি শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আমি পশ্চিমে ডুবে যাওয়া সূর্যের লাল রঙের ফাঁকে ফাঁকে ধোঁয়াশা মেঘগুলো দেখছিলাম। কানে হেনরিক ফ্রেকল্ডারের "Lonely World" শুনছিলাম। ধীরে ধীরে লাল রং ফ্যাকাশে হচ্ছিল, আমি হাঁটতে হাঁটতে ছাঁদের পূর্ব দিকের রেলিং এর পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। কিছুটা দূরেই শহরের মেইন রাস্তার ব্যস্ততা। আমি দেখছিলাম মোটর গাড়িগুলোর লাল হলুদ রঙের আলোর ছায়ায় লোকেদের হাঁটাচলা । তাদের কেউ দ্রুত হাঁটছে কেউবা ধীরে। কেউ আনমনা, আবার কেউ ব্যস্ততায়। গতির যে পরিবর্তন ধর্ম আছে তা আমি বুঝতে পারছিলাম দূরের ওই অজানা মানুষদের গতির পরিবর্তনশীলতা দেখে। স্থির হয়ে আমি তাকিয়ে রয়েছিলাম। কানে চিৎকার করা "Lonely World" এর বিদেশি সুর আর ভালো লাগছিল না। মনে হচ্ছিল চিৎকার করে কাউকে ডাকি, কি করছে ওরা সব? এখনও ভিড় রাস্তায় কেন? নাকি আজকে আবার কোনো উৎসব? যদিও নিজের প্রশ্নের উত্তর আমি জানতাম। তবুও বারবার কাউকে ডাকার ইচ্ছে হচ্ছিল, হোকনা সে অজানা। মনে হচ্ছিল ওদের ভিড়ে কেউ লুকিয়ে আছে। হয়তো কেউ ওই রাস্তার ভিড় থেকে আমায় ডাকছে। কিন্তু সারা দেব কাকে? সবার মুখ যে আবছা ক্রমশ উবে যাওয়া ওই অন্ধকারে। দূর থেকে হলেও অজানা লোকগুলোর চলমান ছায়ায় আমি কিছু একটা দেখতে পাচ্ছিলাম। যেন এক দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবী। ওই অন্ধকার কেন জীবন্ত, ওর মাঝখানে আমি তখন দেখতে পাচ্ছিলাম আমার পরিবার, আমার গ্রাম, গ্রামের হারিয়ে যাওয়া মানুষের মুখগুলি, হরিবাসরের পূজা, পুকুরের পাহাড়ের ক্রিকেট, ছোটবেলার স্কুল শিক্ষক, স্কুল সাথীরা, ছেঁড়া নোটবুক, মার্বেলের গুটি, আলুপোড়া, বাসের টিংলিতে ঘুঘু, গোরুর খড়ের খাঁচা, শীতের ঘরোয়া পিকনিক, তাল কুরোনো, আম চুরি, সব এলোপাথাড়ি। অন্ধকারের মধ্যে যেন স্পষ্ট এলোমেলো পরিচিত ছবিগুলি আরও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। 


    কিছুক্ষন, এভাবেই স্থির হয়ে আমি তাকিয়ে ছিলাম ওই ভিড়ের রাস্তার দিকে। ওই ভিড়ের আলো আমার চোখকে নিপীড়ন করছিলনা আর। বরং ভিড়ের আলোর অন্ধকারে আমি খুজে পেয়েছিলাম আমার হারিয়ে যাওয়া পৃথিবী। হেডফোনের আওয়াজের ইংরেজি গানের শব্দগুলো আর সঠিক উচ্চারিত হচ্ছিলনা কানের ভেতর। কেবল মনে হচ্ছিল একটা অজানা ধুনের সুরে আমি আজকের এই সন্ধার পরিবেশ দেখছি। জানিনা এটা উপভোগ নাকি নস্টালজিয়ার এক চরম পর্যায়। নাকি সচেতন আর অসচেতন মনের মধ্যে চলছিল এক অনুভূতির বিপ্লবী বোঝাপড়া। আর এই বোঝাপড়ার মাঝে রিমিনিসসেন্স বার বার ঢুকে পড়েছিল অস্বাভাবিক-স্বাভাবিক ও সচ্ছলভাবে। সঠিক বিশ্লেষণ জানা নেই আমার। শুধু এটুকু বুঝেছিলাম আজকের সন্ধ্যা ছিল একটু অন্যরকমের। জীবনের একটি প্রকোষ্ঠ একটু অন্যরকম স্বাদে গছিয়ে রাখতে পেরেছিলাম আজ বা পেরেছি। আমি জানি, প্রতিদিনের মতো খালি চোখে দেখলে এই অনুভূতি অন্যদিনের মতোই স্বাভাবিক থাকত। বিশ্বাসের একটা নতুন সংজ্ঞার সংযোজন হয়েছিল আমার স্মৃতিতে। সেই বিশ্বাসই বারবার আমাকে বলছিল, "সাড়ে পাঁচটার পর আবার একই রকম সন্ধ্যা নামবে। আবার অচেনা মানুষের ভিড়ে অন্ধকার নেমে আসবে।" আর আমি আবার খুঁজব আমার হারিয়ে যাওয়া পৃথিবী। তা যে কোনো অন্ধকারেই হোক, আমার বদ্ধ ঘরে কিংবা দুরবর্তী ভিড়ে। এখন শুধু অপেক্ষা ফিরে আসা ওই একই সন্ধ্যাবেলার। 


    পশ্চিমের আকাশেও তখন ঘন অন্ধকার নেমে গিয়েছিল। দু একটা তারা মিট মিট করলে নভেম্বরের অর্ধেক চাঁদ গর্বের সঙ্গে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। আমি অনেক প্রতিশ্রুতি ও বিশ্বাস নিয়ে আবছা সিঁড়িগুলির ধাপ বেয়ে এক-পা দু-পা করে ফিরে এসেছিলাম আমার অ্যাপার্টমেন্ট এর রুমে। 


No comments:

Post a Comment