(ছোট গল্প)
~তাপস সরকার
এখনও ভোর হতে অনেক দেরি ৷
পুর্বদিকের আকাশে আলোর কোনো বিন্দু নেই। আর শেষ রাতের তারাগুলিও নিস্তেজ হয়ে
পড়েছে। বর্ষার ঝিঝিপোকাগুলি সবে তাদের ডাক থামিয়েছে ৷ আর কোথাথেকে একটা ঘন কালো
মেঘ এসে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে চাঁদহীন অন্ধকার রাতটিকে ৷ সবদিকে শুধু অন্ধকার আর
নিস্তবদ্ধতা। হঠাত এই সময় একটা প্রচন্ড মেঘের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল রাজেশের৷ যেন এক
বিস্ফোরিত আকাশ থেকে পরেই তার ঘুম ভেঙ্গেছে। অভেদ্য অন্ধকারে পাগলের মতো চারিদিকে
তাকানোর চেষ্টা করে সে। তার শরীর দারুনভাবে দুর্বল, যেন অসার হাড়গুলি একে অপরের থেকে একেবারে
আলাদা হয়ে আছে৷ রাজেশ অনুভব করে যে তার শরীর আর তার মনের গতিতে চলেনা৷ তবু
অন্ধকারে সে হাতড়াতে থাকে,
উঠে দাঁড়ানোর
চেষ্টা করে। আর সেই সময় একটা দারুণ ঠান্ডা বাতাস এসে তার ভেতরের নড়িভুড়িগুলিকে
জমাট বাঁধিয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে। যদিও এটি বর্ষাকাল, রাতের পরিবেশ
একটু অন্য রকম হওয়ার কথা৷ রাজেশ বুঝে উঠতে পারছেনা তার বর্তমান পরিস্থিতি৷ সে
কোথায়, কেন, কটা বাজে, সে কি একা?
কিছুক্ষণ পর উঠে
দাঁড়ানোর চেষ্টা করে রাজেশ। কিন্তু ব্যার্থ হয়৷ গুমোট অন্ধকারকে ভেদ করে সে
তাকানোর চেষ্টা করে কিছুটা দূরে। আরও একটু দূরে। তাও পারছেনা সে। না, কোনো কিছুই চোখে
পরছেনা তার৷ সামনে, পেছনে, সবদিকে সুধু
অন্ধকার আর অন্ধকার৷ আর এই অন্ধকার তার চোখের নাকি বাইরের জগতের তা বোঝারও ক্ষমতা
নেই তার৷ সে স্পর্শ করার চেষ্টা করে তার হাত, মুখ,
পা ও শরীর।
ব্যর্থ হয়। সবকিছুই যেন তার নাগালের বাইরে৷ সবার থেকে সে আজ অনেক দুরে, অনেক আলাদা।
রাজেশ মনে করতে থাকে তার গতকাল, গতকাল ঘুমিয়ে পরা, ঘুমিয়ে পরার আগের
মহূর্ত৷ ভীষন কষ্ট হয় তার। স্মৃতির যন্ত্রনায় ছটপট করতে থাকে। কোনো কিছুই ঠাওর
করতে ষপারছে না ঠিকঠাক। যেন সব স্মৃতি মুছে গেছে তার৷ তারপর, অন্ধকার আর অন্ধকার।
স্কিংকর্তব্যবিমুঢ় রাজেশ। তার সক্রিয়
অনুভূতিগুলি বিভ্রান্ত হয়ে পরছে বারবার। গাঢ় স্তব্ধতায় তার শরীর লুটিয়ে পরা
স্ট্যাচুর মতো স্থির হয়ে রয়েছে। কেবল বিকলাঙ্গ স্নায়ুগুলি বিদ্যুতের স্পর্শ
হাতড়ায় অন্ধের অনুরূপ। এভাবে একবার আকস্মিকভাবেই মনে পড়ে গেল রাজেশের। হ্যাঁ, গতকালেও সে
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল স্ত্রী সুমী ও মেয়ে সুশ্রীকে তারাতারি বাড়ি ফিরে আসার।
বৃদ্ধা মাও বলেছিল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে। আর বলেছিল এক প্যাকেটে ধুপকাঠি কিনে
আনতে। কিন্তু এখন সে কোথায়?
সে কি বাড়ি
ফিরেনি? নাকি বাড়িতেই? আর এই অন্ধকার? কেনইবা মেঘের
গর্জন? ওহ! শুধু অন্ধকার, ঘন অন্ধকার।
বাতাসের প্রত্যেকটি বালির
কনা যেন বিষাক্ত তিরের মতো বিঁধছে তার শরীরে। স্বাসপ্রস্বাসে ভীষণ যন্ত্রনা। রাজেশ
মনে করতে থাকে তার প্রতিশ্রুতি, মেয়ে সুশ্রীর মুখ। এইতো আজ সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়
সুশ্রী একটি পেনসিল চেয়েছিল। হ্যাঁ, একটি পেনসিল চেয়েছিল তার সুশ্রী। তারপর? তারপর? হঠাৎ তখনই আর একটা প্রচন্ড মেঘের গর্জন।এবার
রাজেশের মনে পরে হ্যাঁ, কর্নজোরা পোলিং
বুথে সে ডিউটি দিচ্ছিল। হ্যাঁ, সে ছিল একজন প্রিসাইডিং অফিসার। তারপর...? আবার ভুল হয়ে
যায় তার, সন্ধ্যা, সকাল, এখন; সামনে, পেছনে শুধু
অন্ধকার আর অন্ধকার। কেউ কোথাও নেই। কেবল শূন্যতা। সে একা।
উদ্বিগ্ন মস্তিষ্কে স্মরণ
করতে করতে রাজেশ এবার দাঁড়িয়েছে কোনোরকমে। তার অনুভব করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মন ও
শরীরের সম্পর্ক, তার বাস্তবিকতা। ঠিক
তখনই সে দেখে একটি তীব্র আলো উজ্জ্বল হয়ে ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছে। আর সেটি তার
দিকেই ছুটে আসছে নির্বিসারে। কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে যায় রাজেশ। সে দেখে আলোটি; কাছে, আরো কাছে, হ্যাঁ তার দিকেই সরে আসছে। সব কিছুই ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে
রাজেশের । কাল, আজ, এখন, রাত। সে ছিল একজন
প্রিসাইডিং অফিসার। হঠাৎ তার মনে পরে, ভোট চলাকালীন
কিছু লোক পোলিং বুথে এসে গন্ডোগোল বাধায়। তারা বুথের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেলে
রাজেশ বাঁধা দেয়, খানিকটা ধস্তাধস্তি হয়ে যায় তাদের সঙ্গে।
বারবার তারা হুমকি দিতে থাকলেও রাজেশ কিছুতেই রাজি হয়নি একজন আদর্শ স্কুল শিক্ষক হিসেবে।
হ্যাঁ, রাজেশ স্বচ্ছ
রেখেছিল ভোটবাক্স। বাঁধা দিয়েছিল দুষ্কৃতীদের। বাঁচিয়েছিল গনতন্ত্র, ভোটাধীকার।
কিন্তু তারপর? কি হয়েছিল তার? আর এই রাত? সে মনে করার
চেষ্টা করে বারবার ভীষণভাবে। আবার ব্যর্থ হয়। আবার…আবার…আবার ।তারপরই সে দেখে
যে আলোটি তার দিকে ছুটে আসছিল সেটি আরো বড় হয়ে গেছে, আরো তীব্র, আরো উজ্জ্বল। সে মনে করতে থাকে তারপর...তারপর...তারপর। একই
প্রশ্ন আতঙ্কিত করে তুলছে তাকে কোথায় সে? সে কোথায়? সে কোথায়? ঠিক এই সময় রাজেশ
শুনতে পায় আর একটা কানফাটা আওয়াজ। সে আওয়াজ তার চেনা। একটা ইঞ্জিনের আওয়াজ। কোন
ইঞ্জিন? কেন? কোথায়? রাজেশ দেখে আলোটি
তার খুব কাছে, আর একটি বিশাল
ইঞ্জিন। এক বিশাল শরীরের মেশিন। সেটার সামনেই সে দাঁড়িয়ে। এক্ষুনি তাকে প্রচন্ড
জোরে ধাক্কা মারবে। সে দ্রুত নিজেকে সরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পা দুটি স্থির ও
অচল। যেন মাটিতে শেকড় গেঁথে আছে চিরকালের জন্য। এ...ই ইঞ্জিনটি আঘাত করবে তাকে।
কোনো পথ নেই। না নেই। রাজেশ চিৎকার করে ওঠে “হেল্প হেল্প হেল্প”। কিন্তু কোনো শব্দ
নেই ইঞ্জিনের বিকট গোঙ্গানি ছাড়া। সবদিকে কেবল সেটারই প্রতিধ্বনি। আবার চিৎকার করে
রাজেশ “হেল্প হেল্প...”, কেউ শুনছেনা তার চিৎকার। সে লুটিয়ে পরে রেললাইনের ধাড়ালো
পাথরগুলির ওপর। আর ততক্ষণে কামরাগুলি গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে তাকে
প্রত্যাখান করে চলে যাচ্ছে হুইশেল দিতে দিতে। সে যেন এক প্রবল ঝড়ের স্রোত। একটু একটু করে চিন্তা
শক্তি লোপ পাচ্ছে তার। সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে, আর অনুভব করে হৃৎস্পন্দনের অনুপস্থিতি। গোটা শরীর ভেঁজা, তার সঙ্গে একটা
গন্ধ অনুভব করে সে যেন মরচে পরা লোহা, লোহীত, নাকি রক্ত! নাকি "মৃত্যু"! রাজেশের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। মৃত্যু, অন্ধকার, আলো, গর্জন, রেললাইন, কাল, আজ কোনোটাই সে
বুঝতে পারছে না। এভাবে কিছুক্ষণ চুপ করে যায় সে। ভীষণ ক্লান্ত।
হ্যাঁ, বারিতেই ফিরতে
চেয়েছিল রাজেশ মনে পরে তার। তখন রাত আটটা, ভোট শেষ হলে সে পোলিং বুথ থেকে
রওনা দেয় বাড়ির দিকে। একটা পেনসিলও কিনেছিল মেয়ে সুশ্রীর জন্য স্পষ্টভাবে মনে পরছে
তার। কিন্তু ধীরে ধীরে স্পষ্ট ছবিগুলি আবার অস্পষ্ট হতে থাকে, তখনই সে দেখে আর একটি
আলো, আর একটি ট্রেন
ছুটে আসছে তার দিকে। রাজেশ এবার কোনোককমে সরে দাঁড়ায় রেললাইনের একটু দুরে। সে দেখে ইঞ্জিনের
তীব্র আলোটির ফোকাস পরেছে রেললাইনে, আর চকচক করছে ইস্পাত দুটি। সেই ইস্পাত দুটির মাঝখানে সে
নিদ্রাচ্ছন্ন ছিল এতক্ষণ! এদিকে রেলগাড়িটি প্রায় দুশো গজের মধ্যে, তার তীব্র
হেডলিইটের আলোয় ভীষন দ্রুত উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ইস্পাত দুটি। আরো পরিষ্কার হয়ে উঠছে রাজেশের
সামনের দিকটা। সে তাকাতে থাকে দুরে চকচকে ইস্পাত দুটি। আর কিছু মুহূর্তেই সে দেখে অদুরে একটা মানুষ চিৎ হয়ে পরে আছে
রেললাইনের মাঝখানে। সে চিৎকার করে ওঠে “কে ওখানে?” কিন্তু কোনো উত্তর নেই। রাজেশ আর একবার
চিৎকার করে ডাকে “কে, কে ওখানে...?”। কোনো সারা নেই। কোনো উত্তর না পেয়ে ছুটে যায় তার দিকে। কাছে যেতেই রাজেশ
দেখে লোকটির মুখ থেতলানো,
রক্তাক্ত। শনাক্ত
করা কঠিন। একটি হাত ও পা অদ্ভুতভাবে বেঁকে রয়েছে। এদিকে ট্রেনটিও ছুটে আসছে দ্রুত
গতীতে। আরও স্পষ্ট দেখাচ্ছে লোকটির রক্তাক্ত শরীর। হঠাৎ সে লক্ষ্য করে একি! এতো
তারই শার্ট, একই পেন্ট সে
পেরেছিল সকালবেলা। ওইতো একটি পা তারই স্যান্ডেল পরে আছে। আর তার
পার্স...? রাজেশ হাতড়াতে
থাকে তার শূন্য পকেট। কোথায় তার পার্স? তাহলে, তাহলে...! হঠাৎ তখনই তার পাশ দিয়ে ট্রেনটি দ্রুত গতিতে
ছুটে চলেছে । বিষ্ময়ে কাঁপতে থাকে রাজেশ। তার শরীর এবার
বাতাসের থেকে আরো হালকা হতে থাকে আর ভেসে যেতে থাকে একই সঙ্গে। ধীরে ধীরে সে মিশে
যেতে থাকে ঘন অন্ধকারের দিকে ম্লান থেকে
ম্লানতর। রাজেশ অস্পষ্ট গলায় চিৎকার করে ডাকতে থাকে “মা, মা আমি বাড়ি
যাবো-তোমার ধুপকাঠি...সুমি,
সুশ্রী...তোমার
পেনসিল”।

No comments:
Post a Comment